শুক্রবার, ১৭ মে ২০২৪, ০৮:৩১ অপরাহ্ন

সংবাদ শিরোনাম :
মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ রায় বাস্তবায়ন হয়নি এক যুগেও

মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও বধ্যভূমি সংরক্ষণ রায় বাস্তবায়ন হয়নি এক যুগেও

স্বদেশ ডেস্ক

বহু ত্যাগ-তিতিক্ষা আর শহীদের রক্তে ভেজা এই মাটি আজ অপেক্ষায় স্বাধীনতার সুবর্ণজয়ন্তী উদযাপনে। যার সূচনা হবে আজ ১৬ ডিসেম্বর স্বাধীনতার ৫০তম বছরে পদার্পণের মাধ্যমে। কিন্তু দুর্ভাগ্য হলো, ৫০ বছর পেরিয়ে গেলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত অনেক স্থান, নিদর্শন ও বধ্যভূমি আজও রয়ে গেছে লোকচক্ষুর অন্তরালে। এর মধ্যে সরকারি-বেসরকারি পর্যায়ে নানাভাবে কিছু চেষ্টা চললেও মুক্তিযুদ্ধের এসব স্মৃতিচিহ্ন রক্ষার কাজ শেষ হয়নি। পাকিস্তানি বাহিনীর নৃশংসতার সাক্ষী বধ্যভূমিগুলো এখনো অরক্ষিত। চিহ্নিত করা হয়নি ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান বর্তমানে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে বঙ্গবন্ধুর ৭ মার্চের ভাষণের স্থান, পাকিস্তানি সেনাদের আত্মসমর্পণের স্থানসহ ঐতিহাসিক জায়গাগুলো। এসব স্মৃতিবিজড়িত স্থান ও বধ্যভূমিগুলো সংরক্ষণে ২০০৯ সালে হাইকোর্টের এক রায়ে নির্দেশনাও রয়েছে সরকারের প্রতি। কিন্তু রায় ঘোষণার পর প্রায় একযুগ পার হতে চললেও তার বাস্তবায়ন পুরোপুরি হয়নি।

২০০৯ সালে জনস্বার্থে বিষয়টি নিয়ে হাইকোর্টে রিট করেন সেক্টর কমান্ডার মেজর জেনারেল কেএম শফিউল্লাহ, ইতিহাসবিদ অধ্যাপক মুনতাসীর মামুন এবং পরিবেশ ও মানবাধিকার সংগঠন হিউম্যান রাইটস অ্যান্ড পিস ফর বাংলাদেশ। রিটের চূড়ান্ত শুনানি শেষে ২০০৯ সালের ৮ জুলাই আদালত সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ওইসব স্মৃতিবিজড়িত স্থানসহ সারাদেশে ছড়িয়ে-ছিটিয়ে থাকা মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিবিজড়িত স্থান, মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সদস্যদের সমাধিক্ষেত্র, বধ্যভূমি চিহ্নিত করার নির্দেশ দেন। এ আদেশ বাস্তবায়নের জন্য এক বা একাধিক কমিটি গঠনেরও নির্দেশ দেওয়া হয়। মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের সমাধিগুলোয় মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ বা স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন ও সংরক্ষণ করতে রায়ের নির্দেশনায় উল্লেখ করা হয়েছিল।

রায়ের পর্যবেক্ষণে বলা হয়, সোহরাওয়ার্দী উদ্যান থেকে বিদ্যমান সব ধরনের স্থাপনা অপসারণপূর্বক কমিটি কর্তৃক চিহ্নিত স্থানগুলোয় আন্তর্জাতিক মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত দৃষ্টিনন্দন এবং ভাবগাম্ভীর্যপূর্ণ স্মৃতিসৌধ নির্মাণ ও সংরক্ষণ করতে হবে। তবে ১৯৭১ সালের ১৬ ডিসেম্বরের আগের কোনো স্থাপনা এবং বিদ্যমান মুক্তিযুদ্ধসংক্রান্ত স্মারক, ভাস্কর্য, স্মৃতিফলক বা স্তম্ভ এ আদেশের আওতার বাইরে থাকবে। এগুলো ব্যতীত অন্য সব স্থাপনা ব্যতিক্রমহীনভাবে অবিলম্বে অপসারণ করতে হবে। কমিটির চিহ্নিত বধ্যভূমিগুলোয় মানসম্পন্ন ও বিবেচনাপ্রসূত সমাধিক্ষেত্র নির্মাণ বা স্মৃতিফলক বা স্মৃতিস্তম্ভ স্থাপন ও সংরক্ষণ করতে হবে। ২০১০ সালের জুলাই মাসে এ রায়ের পূর্ণাঙ্গ কপি প্রকাশ হয়।

কিন্তু ঐতিহাসিক রেসকোর্স ময়দান থেকে মুক্তিযুদ্ধপরবর্তী সময়ে তৈরি করা স্থাপনা এখনো অপসারণ করা হয়নি। ময়দানের স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ সংরক্ষণ তো দূরের কথা, এখনো স্থানগুলো চিহ্নিতও করা যায়নি। উপেক্ষিত রয়ে গেছে মুক্তিযোদ্ধা ও মিত্রবাহিনীর সৈনিকদের সমাধিক্ষেত্র নির্মাণের বিষয়টিও।

এদিকে ৭ মার্চকে জাতীয় ঐতিহাসিক দিবস ঘোষণা চেয়ে ২০১৭ সালে আরেকটি রিট হয়। এ রিটে ৭ মার্চের ভাষণের স্থান চিহ্নিত করে সেখানে বঙ্গবন্ধুর একটি প্রতিকৃতি নির্মাণে চাওয়া হয় নির্দেশনা। এ রিটের চূড়ান্ত শুনানিকালে ঢাকা দক্ষিণ সিটি করপোরেশন গত ১১ ফেব্রুয়ারি একটি প্রতিবেদন দাখিল করে বলেছে, শিশুপার্কের সংস্কারকাজ চলছে। শিশুপার্ক স্বাধীনতাপরবর্তী সময়ে হয়েছে। তাই ২০০৯ সালের রায়ের আলোকে এটি সোহরাওয়ার্দী উদ্যানের ভেতরে থাকারই কথা নয়। এ ছাড়া মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ ২০০৯ সালের আদেশের বিষয়ে কিছুই জানত না, অন্ধকারে ছিল। মন্ত্রিপরিষদ বিভাগ চিঠি দিয়ে গত ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্টকে জানায়, মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রণালয় কর্তৃক সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে বাস্তবায়নাধীন স্বাধীনতা স্তম্ভ নির্মাণ প্রকল্পের তৃতীয় পর্যায়ে ৭ মার্চের ভাষণস্থলে মঞ্চ পুনর্নির্মাণ ও বঙ্গবন্ধুর তর্জনী উত্তোলিত প্রতিকৃতি স্থাপনের প্রয়োজনীয় ব্যবস্থা গ্রহণ করবে। অবশ্য ইতোমধ্যে সোহরাওয়ার্দী উদ্যানে স্বাধীনতা স্তম্ভ প্রকল্পের দুটি পর্যায়ে গ্লাস টাওয়ার, শিখা চিরন্তন, স্বাধীনতা জাদুঘর, ফোয়ারা, জলাধার ও উন্মুক্ত মঞ্চ তৈরি করা হয়েছে। এ অবস্থায় গত ফেব্রুয়ারিতে হাইকোর্ট ২০০৯ সালের ওই রায় বাস্তবায়ন না হওয়ায় ক্ষোভ প্রকাশ করেন।

হাইকোর্ট বলেন, বঙ্গবন্ধুকন্যার নেতৃত্বাধীন সরকার এখন রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায়। স্বাধীনতার সপক্ষের শক্তি রাষ্ট্রীয় ক্ষমতায় থাকার পরও যদি ঐতিহাসিক রায় বাস্তবায়ন না হয়, তা হলে তা কে করবে। সরকারি কর্মকর্তাদের কতভাবে সুযোগ-সুবিধা দেওয়া হচ্ছে, কিন্তু সরকারের নীতি বাস্তবায়নে ওনাদের খুব একটা আগ্রহ দেখা যায় না। এটাই হলো আমাদের দেশের আমলাতন্ত্র।

পরে আদালত মৌখিকভাবে কেন ২০০৯ সালে দেওয়া ওই রায় বাস্তবায়ন হয়নি তা মন্ত্রিপরিষদ সচিবকে জানাতে বলেন। কিন্তু এখনো তা হাইকোর্টকে লিখিতভাবে জানানো হয়নি বলে জানিয়েছেন রাষ্ট্রপক্ষের আইন কর্মকর্তা ডেপুটি অ্যাটর্নি জেনারেল আবদুল্লাহ আল মাহমুদ বাশার। তিনি বলেন, আমরা বিষয়টি মন্ত্রিপরিষদ বিভাগকে জানিয়েছি। কিন্তু কোভিডের কারণে সবকিছু একটা স্থবির অবস্থায় আছে। এখনো আপডেট তথ্য আসেনি। তথ্য এলেই সেটা আমরা আদালতে দাািখল করব।

এ বিষয়ে জানতে চাওয়া হলে রিটকারী আইনজীবী মনজিল মোরসেদ বলেন, বর্তমান সরকারকে মুক্তিযুদ্ধের পক্ষের সরকার হিসেবে জাতি গণ্য করে। কিন্তু এ সরকারের আমলেও মুক্তিযুদ্ধের স্মৃতিরক্ষার রায় উপেক্ষিত থাকছে। সরকার এ রায় বাস্তবায়নে আন্তরিক নয়। আমরা রায় বাস্তবায়নে প্রয়োজনে আদালত অবমাননার মামলা দায়েরের উদ্যোগ নেব।

তবে মুক্তিযুদ্ধবিষয়ক মন্ত্রী আ ক ম মোজাম্মেল হক শোনালেন আশার কথা। আমদের সময়কে তিনি বলেন, ‘এসব স্মৃতিবিজড়িত স্থানসমূহ রক্ষার কাজ শুধু রায়ের কারণেই নয়, মুক্তিযুদ্ধের চেতনার কারণে বাস্তবায়ন হওয়া দরকার। এ জন্য একাধিক প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। বঙ্গবন্ধু যে জায়গায় দাঁড়িয়ে ৭ মার্চের ভাষণ দিয়েছিলেন, সেখানে তার ভাস্কর্য নির্মাণের জন্য প্রকল্প হাতে নেওয়া হয়েছে। এখন কাকে নির্মাণের দায়িত্ব দেওয়া হবে, সেটা নির্ধারণের কাজ চলছে। এ ছাড়া আমরা ২৭১টি বধ্যভূমি চিহ্নিত করেছি। যার মধ্যে ৩৫টি বধ্যভূমি সংরক্ষণের কাজ প্রায় শেষ। এ ছাড়া ঐতিহাসিক স্থানগুলোও চিহ্নিতকরণের কাজ শেষ হয়েছে। আশা করছি শিগগিরই এসব কাজ শেষ করতে পারব।’

দয়া করে নিউজটি শেয়ার করুন..

© All rights reserved © 2019 shawdeshnews.Com
Design & Developed BY ThemesBazar.Com
themebashawdesh4547877